“ত্যাগ”
কলমে: শ্যামল কুমার মিশ্র
কতখানি ত্যাগ করলে একটা মানুষ ইতিহাস হয়ে যায়
কতখানি ত্যাগ করলে একটা আকাশ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে
কতখানি ত্যাগ করলে আমি আমরা তে বিলীন হয়ে যায়
কতখানি ত্যাগ করলে আমি ভালোবাসতে পারি
সেই নির্মোহ ভালোবাসা
যে ভালোবাসায় ঘর ছাড়ে মানুষ
স্নিগ্ধ এক প্রশান্তি নেমে আসে চারিদিকে
যে ভালোবাসায় গৃহত্যাগী হয়েছিল বুদ্ধ
অক্লেশে অবহেলে সবার অগোচরে
কতখানি ত্যাগ করলে…
প্রশ্নটা কুরে কুরে খায়
রাত্রির দ্বিপ্রহরে কৃষ্ণ দ্বাদশীর চাঁদ যখন আলো ছড়ায়
বাতায়ন পাশে চাঁদ নেমে আসে
ফিসফিসিয়ে বলে যায়—
ত্যাগেই তোমার নিবৃত্তি
ত্যাগেই তোমার মুক্তি…
ধীরে ধীরে চাঁদ ডুবে গেলে
এক নিঃসীম আঁধার জেগে থাকে
গির্জার ঘড়ি ঢং ঢং করে বেজে যায়
যেন বলে যায়—যাওয়ার সময় হল আজ…
কবি পরিচিতিঃ-
কবিঃ শ্যামল কুমার মিশ্র
কোথা থেকে শুরু করব এমনটা ভাবতে ভাবতে যখন অনেকটা সময় কেটে গেছে তখন মেঠোপথের বাঁকে ছেলেটির সঙ্গে দেখা। সকালবেলা হন্তদন্ত হয়ে চলেছে প্রাইমারি স্কুলে। খুব যে আনন্দের সঙ্গে বিদ্যালয় গমন তা নয় কিন্তু মায়ের কড়া নির্দেশ– স্কুলে যেতেই হবে। ছেলেটির ভয় করে ঐ অঙ্কের মাস্টারমশাইকে। শুকনো চেহারা,হাফ হাতা বাংলা শার্ট, হাঁটুর উপর ধূতি– বিষয়ের কাঠিন্যের সঙ্গে চেহারার কাঠিন্য মিশে বিষয়টিকে ছাত্রের কাছে আরো কঠিন করে তুলেছিল। যদিও স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর ঐ কঠিন মাস্টারমশাই এর সঙ্গে এক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।খুঁজে পেয়ে ছিল এই আপাত কাঠিন্যের অন্তরালের মানুষটিকে যা বড়ই কোমল।
তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। পূর্ব মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামের(নাম: জাহানাবাদ) ঐ ছেলেটি প্রাইমারী ছাড়িয়ে ভর্তি হয় শতাব্দী প্রাচীন এক জাতীয় বিদ্যালয়ে(কলাগেছিয়া জগদীশ বিদ্যাপীঠ) যেখানে একসময়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ও চারণকবি মুকুন্দ দাসের পদার্পণ ঘটেছিল। হাজারো স্বপ্ন তখন ছেলেটির দুচোখে। স্কুলে থাকতে থাকতেই ছেলেটি আদর্শ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্নে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার হাতছানি থেকে সরে আসে ছেলেটি।আর তাই রসায়নে সাম্মানিক নিয়ে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ভর্তি হওয়া। স্কুল জীবনের লেখালেখির অভ্যাস এই আশ্রমিক পরিবেশে আরও শানিত হয়।এই আশ্রমিক জীবন ছেলেটির জীবনের এক বাঁক। আদর্শ ও শৃঙ্খলার ঘটল মেলবন্ধন। মহাবিদ্যালয়ের পাঠ শেষে বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর গবেষণায় রত হয় ছেলেটি কিন্তু বাধ সাধে দারিদ্র্য। গবেষণাগার থেকে উত্তর ২৪ পরগণার এক প্রান্তিক স্কুলের শিক্ষক। ইছামতির সঙ্গে সহবাস। প্রান্তিক এই স্কুল ছেলেটিকে দুই বাংলার মানুষদেরকে নতুন করে চিনতে শেখায়। দশ বছর পেরিয়ে আবার কলকাতায় ফেরা। এবারে যাদবপুরের এক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষায়তনের প্রধান শিক্ষক হিসেবে এই প্রত্যাবর্তন। এক নতুন অধ্যায়ের শুরু। এই দীর্ঘ পরিক্রমণের অপরাহ্ণ বেলায় শুরু হয় অতিমারি। আর তা যেন ফিরিয়ে দেয় নরেন্দ্রপুরের সেই পত্রিকা সম্পাদককে। আবার লেখা লেখি শুরু। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ থেকেই চাকুরিরত অবস্থাতেই বাংলাভাষায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর একটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ‘বিদ্যাসাগর রিসার্চ সেন্টার’ আয়োজিত বিদ্যাসাগর বিষয়ক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন যা আজ বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষে ছেলেটিকে বড় আনমনা করে তোলে। মনে পড়ে যায় বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র সন্তোষ কুমার অধিকারী ও স্বামী প্রভানন্দ মহারাজের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ। লেখাপড়া আর ছাত্রদের নিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেছে। ২০১৮ তে আনন্দ বাজার পত্রিকার ‘দ্রোণাচার্য্য’ সম্মানে সম্মানিত হয়েছে ছেলেটি। মূল্যবোধের অপহ্নবে ভুগতে থাকা মানুষজনের জন্য কষ্ট পায় ছেলেটি। তাই বিভিন্ন পেশার মানুষদের নিয়ে গড়ে তুলেছে ‘মনীষী চর্চা কেন্দ্র’। সঠিক বৈজ্ঞানিক মনন সমৃদ্ধ আদর্শ মানুষ তৈরি যার মূল লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্য পূরণে “মনীষী চর্চা কেন্দ্র” দৌড়ে গেছে সাগর থেকে মেদিনীপুর।
পূর্ব মেদিনীপুরের সেই গ্রামের ছাত্রটির পরিক্রমণ আজ ও অব্যাহত। চাকুরী জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় পৌঁছে এমন করে আত্মদর্শনের সুযোগ দেওয়ায় ‘কাব্যকথা’ পরিবারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
— প্রত্যক্ষ উক্তিতে কবি।