দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা ছিল অন্য যেকোনো পক্ষের চেয়ে বেশি। নিজেদের সর্বশক্তি নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মার্কিনরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন আঞ্চলিক মহাসাগরগুলোতে জাপানিদের বিরুদ্ধে মার্কিন নৌবাহিনী বরাবরই নজরদারি মিশন পরিচালনা করতো। আর এই নজরদারিতে গিয়ে এমন অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে যেগুলোর সত্য আজও উন্মোচিত হয়নি। এমনি এক অমীমাংসিত রহস্যময় ঘটনা ‘ঘোস্ট ব্লিম্প’।
নৌবাহিনীর দুই সদস্য দ্বারা পরিচালিত একটি গ্যাস বেলুন ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে টহল দিতে যায়। মূলত জাপানি নৌবাহিনীর গতিবিধি ও মার্কিন উপকূলে তাদের অবস্থান চিহ্নিত করতে আকাশপথে তাদের সেখানে পাঠানো হয়। কিন্তু গ্যাস বেলুনটি ফিরে আসলেও ফেরেননি এতে থাকা দুজন ক্রু। তাদের একজনের নাম লেফটেন্যান্ট আর্নেস্ট ডিউইট কোডি এবং অন্যজন এনসাইন চার্লস এলিস অ্যাডামস। তাদের না ফেরার কারণ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব গণমাধ্যমে একাধিক গুঞ্জন রয়েছে।
মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, জাপানি সেনারা ওই দু’জনকে আটক করে নিয়ে গেছে। আবার অনেকে বলেন, নারীকেন্দ্রিক বিবাদে জড়িয়ে তারা একে অপরকে হত্যা করেছেন। ঘটনা যাইহোক না কেন, এর পেছনের সত্যতা জানা দরকার। অভিযান থেকে ফেরার ৫ ঘণ্টা পর এল-৮ নামক ওই নজরদারি গ্যাস বেলুনটি ডেলি সিটির একটি শহরতলির রাস্তায় বিধ্বস্ত হয়। এতে করে সেখানকার বৈদ্যুতিক লাইন বিধ্বস্ত হয় এবং পুরো এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অগ্নিনির্বাপক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নেভাতে শুরু করেন। নৌবাহিনীর গ্যাস বেলুন হওয়ায় উদ্ধারকারীদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল এতে থাকা ক্রুদের উদ্ধার করা। কিন্তু তারা সকল ধ্বংসাবশেষ থেকে একজনেরও খোঁজ পাননি। মার্কিন নৌবাহিনী নিশ্চিত করে, দুজনই নিখোঁজ হয়েছেন।
এই ঘটনার পর ইউরোপ ও আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে বিধ্বস্ত ওই এল-৮ বেলুনটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পত্রিকাগুলোর কল্যাণে ওই বেলুন নিয়ে রহস্য বাড়তেই থাকে। মার্কিন জনগণ একে ঘোস্ট ব্লিম্প নামে পরিচিত করে তোলেন। যার অর্থ দাঁড়ায় ভূতুড়ে বেলুন। যাইহোক, ওই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ ৮ মাস জাপানি বাহিনীর আক্রমণে ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে বরাবরই নজরদারিতে ব্যস্ত থাকতো মার্কিন নৌবাহিনী। আর এই কারণেই তখন এসব গ্যাস বেলুনের ব্যবহার শুরু করে তারা। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় দুজন ক্রু নিয়ে চালনাযোগ্য এসব বেলুনকে নজরদারির জন্য নিরাপদ ভাবতেন সে সময়ের সামরিক কর্তারা।
দেশটির উপকূলে মার্কিন এয়ারক্রাপ্ট ক্যারিয়ার অবস্থান করছিল। নৌবাহিনী শুধুই আমেরিকান ভূখণ্ডের নিরপত্তায় নিয়োজিত ছিল না, তারা সে সময়ের সর্বাধিক ব্যয়বহুল বিমানবাহী রণতরীর নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতেন। আর এই কারণেই সেখানকার নজরদারিতে এমন পন্থা অবলম্বন করতেন সেনারা। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ড্যান গ্রসম্যান বলেছেন, ‘ব্লিম্পের উপকূলীয় টহলের নিখুঁত অপারেশনাল ক্ষমতা ছিল। এটি দীর্ঘ সময় বাতাসে ভেসে থাকতে পারে, এটি ধীরে ধীরে খুব কম উচ্চতায় উড়তে পারে। শুধু তাই নয়, এটি লক্ষ্যবস্তুর উপর ঘোরাঘুরি করতে পারে এবং কম দৃশ্যমান মেঘের উপস্থিতিতে কাজ করতে পারে।’
ওই এল-৮ বেলুনটি তৈরি করেছিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টায়ার। ১৯৪২ সালের গোঁড়ার দিকে মোট ৪টি ব্লিম্পের ডেলিভারি পায় মার্কিন নৌবাহিনী। সেগুলোকে পরে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্লারা কাউন্টির মফেট ফিল্ডে স্থাপন করা হয়েছিল। সেখান থেকে মার্কিন এয়ারক্রাপ্ট ক্যারিয়ারগুলো খুবই নিকটে ছিল। ডেলিভারি পাওয়া অন্য ব্লিম্পগুলো নিউ জার্সির লেকহার্স্টে স্থাপন করা হয়। ওই স্থানেই ১৯৩৭ সালে হিন্ডেনবার্গ বিপর্যয় ঘটেছিল।
মার্কিন নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, কোডি এবং অ্যাডামস দু’জনেই অভিজ্ঞ এয়ারশিপ পাইলট ছিলেন। ২৭ বছর বয়সী কোডি ১৯৩৮ সালে নেভাল একাডেমি থেকে স্নাতক শেষ করেন। ওই নজরদারি মিশনে তার সফরসঙ্গী হিসেবে থাকা ৩৪ বছর বয়সী অ্যাডামস প্রায় এক দশক ধরে নৌবাহিনীতে ছিলেন। ওই মিশনে যাওয়ার পূর্বে তিনি অফিসার পদে কমিশন লাভ করেন। ওই ঘটনার আগে একাধিক এয়ারশিপ বিপর্যয় থেকে বেঁচে ফেরেন তিনি। তবে ওই অভিযানে তাদের সঙ্গে তৃতীয় আরেক পাইলটের যাওয়ার কথা ছিল। ওই পাইলটের নাম জেমস রিলি হিল। তিনি একাধারে ছিলেন একজন প্রকৌশলী। এল-৮ ট্রেজার আইল্যান্ড ছেড়ে যাওয়ার ঠিক আগে কোডির নির্দেশে তাকে নামিয়ে দেয়া হয়। হিলকে তখন বলা হয়েছিল অতিরিক্ত ওজন কমাতে এই সিদ্ধান্ত নেন ওই দুজন।
যাত্রার প্রথম এক ঘণ্টা ঠিকঠাক ছিল সবকিছু। এরপর সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে পাইলটরা রেডিওর মাধ্যমে জানায় যে, তারা সমুদ্রের পানিতে তেলের চিহ্ন দেখেছেন। এটি একটি সাবমেরিনের সম্ভাব্য ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নেন নৌবাহিনীর কর্তারা। কিন্তু এটিই ছিল দুই পাইলটের কাছ থেকে শোনা শেষ বাক্য। এল-৮ থেকে পুনরায় আর কোনো রিপোর্ট না পেয়ে অনুসন্ধানের জন্য বিমান প্রেরণ করে নৌবাহিনী। বিমানের পাইলটেরা জানান, বেলুনটি অবরতণ করেছে এবং দুই পাইলট নিরাপদে বেরিয়ে গেছেন। যদিও ওই তথ্যটি মুহূর্তের মধ্যে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ব্লিম্পটি প্রায় এক মাইল দূরে একটি সৈকতের দিকে নামতে নামতে চলে যায় ডালি শহরের দিকে। ডালি সিটিতে পুলিশ এবং ফায়ার ডিপার্টমেন্টের উদ্ধারকারীরা ব্লিম্পের দরজা খুলে দেখতে পান আগুন বা অন্যা কোনো ক্ষতির চিহ্ন নেই। এর রেডিও তখনও চলছিল। দুজন পাইলটের জন্য নির্ধারিত প্যারাসুটগুলোও নির্দিষ্ট স্থানে রাখা আছে। এতে করে আন্দাজ করা হয় তারা বিপদে পড়ে ঝাঁপও দেননি।
ওই ঘটনার তদন্ত শুরু হলে রহস্য আরও বাড়তে থাকে। ওই একই দিন সান ফ্রান্সিসকোর জেলেদের বেশিরভাগই মাছ ধরতে নেমেছিলেন। অনেকেই তখন বেলুনটিকে উড়তে দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানা যায়, যখন বিম্প থেকে দুই পাইলট তেলের চিহ্ন দেখেন তখন তারা দুটি অগ্নিশিখা ফেলে বেলুনকে আরও উপরে তোলেন। অন্য একটি অনুসন্ধানি বিমানের বরাত দিয়ে জানা যায়, বেলুনটি প্রায় ২ হাজার ফুট উপরে ছিল যা এর স্বাভাবিক উচ্চতারও দ্বিগুণ ওপরে। আকাশে একে উড়তে দেখে অনেকে এর ছবি তুললেও পড়ে পুলিশের কড়া জেরার মুখে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা একে অপরের বিপরীত সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে তখনকার তদন্তকে ভুল পথে পরিচালিত করেন। ওই এলাকায় ঘোড়ার পিঠে চড়ে একজন মহিলা বলেছিলেন, তিনি দু’জন নয়, দূরবীন ব্যবহার করে তিনি ৩ জনকে দেখেছেন।’
যাইহোক, মার্কিন নৌবাহিনী তাদের খুঁজে পেতে সাগরের তলদেশেও অনুসন্ধান শুরু করে। তাদের বিশ্বাস ছিল, কোডি এবং অ্যাডামসকে একটি জাহাজে তুলে নেয়া হয়েছিল। যদিও আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ তাদের লাইফজ্যাকেটের চিহ্ন খুঁজে পায়নি। নৌবাহিনী কার্যত ব্যর্থ হয়ে আশা ছেঁড়ে দেয়। এতে করে তাদের নিয়ে পরবর্তী কয়েক দশক ধরে, অসংখ্য তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটে। অনেকে বলেছেন, তারা দলত্যাগ করে জাপানীদের সঙ্গে যোগদান করেছেন। আবার অনেকের মতে, তাদেরকে খুন করা হয়েছে। তবে শেষে নৌবাহিনী অনুমান সাপেক্ষে মেনে নেয়, দুই পাইলট ব্লিম্প থেকে পানিতে পড়ে নিখোঁজ হয়েছেন।
অনুমান সাপেক্ষে সিদ্ধান্তের কারণে এখনও এই নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি। বরঞ্চ এটি নিয়ে সংবাদপত্রে, বইতে কিংবা সিনেমা জগতে নতুন নতুন গল্প তৈরি হচ্ছে। ৮০ বছর পরেও সমাধান হয়নি ওই দুজনের নিখোঁজের আসল রহস্য। যদিও ওই দুর্ঘটনার পর ফের সার্ভিসে আসে এল-৮ ব্লিম্পটি। ১৯৮২ সালে এটিকে অবসরের পাঠানো হয়েছিল। বর্তমানে এটি ফ্লোরিডার ন্যাশনাল নেভাল এভিয়েশন মিউজিয়ামে রয়েছে।
তথ্যসূত্র: স্মিথসোনিয়া/ গ্রেগ ডগারটি