এসো একটা গল্প বলি
—রণেশ রায়
ও তুমি এসেছ ! এসো এসো বস। এতদিনে সময় হল। সেদিন হঠাৎ দেখা হবার পর কতদিন হয়ে গেল।সামনের চেয়ারটায় বস। মুখোমুখি ।কত কথা জমা আছে। বলব বলব বলেও বলা হয় নি।আজ যখন এলে বলি। কেন এসেছ জানি না।জানতে চাইও না।সেদিন আসতে বলেছি। এতদিনে এলে। আসবে ভাবি নি। বলাটা ছিল আমার সদাচার। এসেছ এটাই যথেষ্ট। কোনোদিন দেখা হবে ভাবি নি। কি বললে ? ‘‘ভরং কর না। যা বলবার বল না।‘‘ হ্যাঁ বলছি। কোন ভরং ভনিতা নয়। যা এতদিন চেপে রেখেছি বলব সবটা। কিছু গোপন করব না। ধরে নিচ্ছি তুমি জানতে এসেছ কেন ডেকেছি। হয়ত ভেবে এসেছ আমি কিছু বলতে চাই। সেটা ঠিকই আমি কিছু বলতে চাই। তোমার ভাবাটা আর আমার চাওয়াটা হয়ত কাকতালীয়। মিলে গেছে। কিন্তু তাও তো সত্য।
এবার বলি। শুরু করি আমার গল্পটা। হয়ত পুরনো কাসুন্দি ঘাটা। পুরোন মানে পঞ্চাশ বছর আগের কথা। মনে পড়ে আমাদের সেই প্রথম আলাপ? হ্যাঁ ঠিকই বলেছ কলেজে। সেই ঠাকুর পুকুর কলেজে। তুমি আমি দুজনেই ইতিহাস নিয়ে পড়ব বলে ভর্তি হয়েছি। তুমি আসতে বেহালার একটা বর্ধিষ্ণু এলাকা থেকে। শহরের মেয়ে। আর আমি আমতলা ছাড়িয়ে ভেতরে এক গ্রাম থেকে। সেদিন সেটা অজপাড়াগা। আমি গ্রাম্য ছেলে। দুজনের মিল নেই তাও আমি মিল খুঁজি। তোমাকে ভালো লাগে। কিন্তু কোথায় যেন দূরত্ব। তুমি তোমার মত আমি আমার মত। আমার তোমাকে ভালো লাগলেও তোমার আমাকে ভালো লাগে কি না বুঝি নি।আর সংশয় ছিল আমাকে তোমার ভালো লাগবে কেন? তুমিও বুঝতে দাও নি। সংকোচে দ্বিধায় কোনদিন বলা হয় নি যা আমি বলতে চেয়েছি। তাও দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আর বন্ধুত্বটা গড়ে উঠেছিল পড়াশুনাকে কেন্দ্র করে।তোমার মধ্যে একটা জানার কৌতূহল ছিল। আর ইতিহাসে আমার দখলটা স্কুল থেকেই। সেটা তুমি বুঝতে পেরেছিলে। সেটাকে সন্মান দিতে। তাই এই অজপাড়াগায়ের ছেলেটাকে সমীহ করতে। ইতিহাসের ঔৎসুক্য নিয়ে তুমি আমার কাছে আসতে। জানতে চাইতে। সেই নিয়ে দুজনে বন্ধুত্ব। সেটা অবশ্য কোনদিন ক্লাসের চৌকাঠ পেরোতে পারে নি। তাই দুজনে আর কোনোভাবে দুজনকে চিনতে পারি নি। যদিও তোমাকে মনে মনে ধরতে চেয়েছি কিন্তু কোনদিন ধরতে পারি নি। আর তুমিও ধরা দাও নি। পরে ভেবেছি নিজেই নিজেকে ঠকিয়েছে।যদি একটু আগ্রাসী হতাম মনের কথাটা প্রকাশ করতাম তবে হয়তো সমীকরণটা অন্যরকম হত। অমিলটা মিলত।যাই হোক সেটা হবার নয়।হয় নি। তা নিয়ে আপসোস করে লাভ নেই। হয়তো ভাবছ আজ কথাগুলো অবান্তর। এ কথা বলে লাভ কি। হ্যাঁ কি বললে ? অবান্তর তাও বলছি , বলার সময় এসেছে তাই বলছি। ঠিকই অবান্তর। আমিও তাই ভাবতাম। সেজন্য গত পঞ্চাশ বছরে এ নিয়ে ভাবি নি, ভুলে যেতে চেয়েছি। কিন্তু সেদিন দেখা হওয়ার পর বিষয়টাকে আজ আর অবান্তর বলে মনে হচ্ছে না। সেদিন তোমাকে আসতে বলাটা বাইরে থেকে সদাচার মনে হলেও এর মধ্যে অন্য কিছু বোধ হয় ছিল।সেটা আজ বলব বলেই এতক্ষণের এই ভনিতা যেটা তুমি বললে।
আমার কথায় আসার আগে তোমার কথায় আসি। অবান্তর অতীতকে ভুলতে চাইলেও কি ভোলা যায়? সেটা মনের আলোয় ধিক ধিক করে আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে।একটা ঔৎসুক্য থাকে এর পেছনে।সে ঔৎসুক্যটা বনানীর সবুজে সবুজে সমুদ্রের ঢেউ এ ঢেউ এ সূর্যের রোদ্দুরে বাতাসের দোলায় মনের গহনে খেলা করে।দেখলে গল্প বলতে বসে কবিতা করে ফেললাম। তা তুমি তো কবিতা ভালোবাসতে। এ আলাপচারিতায় সেটা না হয় একটু ঝালিয়ে নিলাম । এবার গল্পে আসা যাক। তোমার সম্পর্কে আমার ঔৎসুক্যটা যে বরাবরই ছিল। সে প্রথম আলাপের দিন থেকেই।তবে ঔৎসুক্যটা ঔৎসুক্যই থেকে গেছে।মনের কোনে জ্বলতে থাকে। সেটা ছিল বলেই খোঁজ নিয়ে জেনেছি এম এ পাশ করার পর তুমি কলেজে পড়াতে ঢুকেছ। আর এম এ ক্লাসেও তুমি আমার সহপাঠিনী তাই সময়ের দৈর্ঘ্যে বারতি সময়ের আলিঙ্গনে ঔৎসুক্যটা আরও তীব্র ভাবে জ্বলত কারণ আমি শৈশব থেকে পূর্ণ যৌবনে পৌঁছেছি ততদিনে। বন্ধুত্বটাও অটুট ছিল।সে যাই হোক, তারপর তুমি বিয়ে কর। জেনেছি একটা ছেলেও আছে। সে নিশ্চয় আজ প্রতিষ্ঠিত। আবার কি বললে, ‘‘আমার বিয়ে বেশিদিন টেকে নি‘‘। এই শুনলাম। এ খবরটা জানা ছিল না। এদিকে আমিও বিয়ে করে সংসারী হয়েছি জীবনে অনেক টানা পোড়েনের পর। সে এক ইতিহাস। সেটা আর বলছি না। এবার আসি আসল কথায় যেটা আমার বলা হয় নি আর একটা কথা যেটা এখন আমি জেনেছি সেটা বলি।
আগেই বলেছি আমার তোমাকে প্রথম আলাপেই ভালো লেগেছিল। কিন্তু বলা হয় নি বলতে পারি নি। জানি না তোমার আমাকে ভালো লাগত কি না। বুঝতাম না। বছর কয়েক আগে হাসপাতালে সেদিন দেখা হওয়ার পর না বলা না কওয়া কথাটা বুঝলাম আর না বলা কথাটা বলার তাগিদটা বেড়ে গেল। আমি সেই কলেজের সুদেষ্ণাকে যেন নতুন করে চিনলাম। কি বললে? বুঝতে পারছ না আমি কি বলতে চাই। হ্যাঁ তবে শোন বুঝিয়ে বলি। আমার স্ত্রী অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। আমি তাকে দেখতে গেছি। সেখানে তোমার সঙ্গে দেখা।তুমি গেছ তোমার এক আত্মিয়াকে দেখতে। কারও কাউকে চিনতে অসুবিধে হয় নি। তোমার সঙ্গে তোমার ছেলে ছিল। ওর সঙ্গে আলাপ হল। বেশ সপ্রতিভ হাসিখুশি ছেলে তোমার। আমার স্ত্রী সম্পর্কে সব জেনে তার বেড নম্বর ওয়ার্ড নম্বরটা নিয়ে তুমি গেলে আত্মিয়াকে দেখতে।আমি গেলাম স্ত্রীর কাছে।কেবিনে গিয়ে দেখি নার্সরা স্ত্রীর অপারেশন করতে হবে বলে তোড়জোড় করছে। তৎক্ষণাৎ রক্ত চাই। রক্তের ব্যবস্থা করতে হয়। আমি পরলাম বিপদে।আমার লোকবল নেই। কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না। আমাকে জানান হল কেউ রক্ত দিলে ভালো হয়।ওরা তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা করে দেবে।এটা তাড়াতাড়ি করা দরকার। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই সময় আত্মিয়াকে দেখে তুমি এলে ছেলেকে নিয়ে। সব শুনে ছেলেকে রক্ত দিতে বললে।তোমার ছেলে হাসিমুখে এগিয়ে এলো।রক্ত দেওয়া হলো অপারেশন হলো।তোমরা সর্বক্ষণ আমার পাশে। আমি আমার কলেজের সেই বান্ধবীকে এই বিপদে পাশে পেলাম। সব হয়ে গেলে তুমি চলে যাবে তখন আমি তোমাকে একদিন আসতে বললাম। তুমি আজ এসেছ। সেদিন তোমাকে নতুন করে চিনলাম।তুমি আমার একজন নেহাত কলেজের বন্ধু নও আরও কিছু। পুরোন বন্ধু বলে তোমার মানবিকতাটা আমার কাছে আরও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠল। সেই তুমি যাকে আমার ভালো লাগত কিন্তু সেটা বলতে পারি নি। আজ সেই বন্ধুত্ব নতুন মাত্রা পেল। তুমি শুধু বন্ধু নও একজন মানবিক বন্ধু। বন্ধুত্বের বন্ধনটা যেন আরও দৃঢ় হল। যদি কলেজে দুজনে দুজনকে ভালো লাগার কথা বলে জোট বাঁধতাম তবে সেই জোট বাঁধার থেকে আজকের এই জোট বাঁধাটা অনেক বড়। সেদিন জোট বাঁধলে ধরাবাঁধা সংসারে আটকে থাকতাম কিন্তু সংসারের ধোয়াসে দৃষ্টিতে আজের তোমার মানবিক রূপটা দেখতে পেতাম না।
হঠাৎ কথা বলতে বলতে সুজয়ের চোখ খোলে। সুদেষ্ণা কিছু বলতে চেয়েছিল সেটা তার বলা হলো না।সুজয়ের ঘুম ভাঙ্গলো। সে দেখে একটা ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল যেন। সে সুদেষ্ণাকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারে না। দেখল তার স্ত্রী তার সামনে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে।
কবি পরিচিতিঃ-
নাম : রণেশ রায়
জন্মস্থান: অবিভক্ত পূর্ববঙ্গ, সুসং দূর্গাপুর, ময়মিনসিং জেলা।
জন্ম: ১৬/০৪/১৯৪৫
ঠিকানা : ৫৮৭ পর্ণশ্রী কলকাতা ৭০০০৬০
জীবিকা : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।
অবসর জীবন : লেখালেখি।
কবির কবিতা লেখার পেছনের কথা—
কবির বাবা প্রয়াত সুখদা চরণ রায় মা প্রয়াতা সুধারানি রায়। বাবা ছিলেন কর্পোরেট কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় চাকুরীরত একই সঙ্গে সুলেখক। তিনি বেশ কিছু ছড়া লিখেছেন যার কয়েকটি নিয়ে একটা বই আছে। মা খুব ছোটবেলায় বিয়ে হয় বলে আনুষ্ঠানিক পড়াশুনায় তেমন এগোতে পারেন নি। তবে কবির প্রাথমিক সাহিত্য চর্চা মায়ের হাত ধরে।
কবি লিখতেন প্রধানত প্রবন্ধ। কবিতা লেখা শুরু করেন বছর আট-নয় আগে। জীবনে অসুস্থতাজনিত একটা অঘটন ঘটে যাওয়ায় তার ঋণাত্বক সম্ভাব্য প্রভাবের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য কবি কবিতা লেখা শুরু করেন। অর্থাৎ একটা ঋণাত্বক বিষয়কে ধনাত্বকে পরিণত করার একটা প্রচেষ্টা এটা। এটা কবির জীবনের বিশ্বাসের অঙ্গ যা নিয়ে কবি বেঁচে থাকায় বিশ্বাস করেন। এতেই আনন্দের সঙ্গে ভবিষ্যতের আশা নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব বলে মনে করেন। সেই অর্থে কবির কবিতা লেখাটা সমাজ আন্দোলনের অঙ্গ বলে মনে করা যেতে পারে। লেখার জন্য লেখায় কবি বিশ্বাস করেন না। জীবনের চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন ঘটা উচিত লেখায় বলে মনে করেন। দুরূহ বিমূর্ত লেখায় কবি বিশ্বাসী নন।
কবি যেন কবির লেখার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। কবি স্বীকার করেন, একটা অহং কবির মধ্যে কাজ করে। মনে হয় এই লেখাই ছিল কবির জীবন। সে পথে অনেক আগেই যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটা না করে ভুল করেছেন। ফলে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারেন নি। অসম্পূর্ণ এক মানুষ কবি। নিজের পথ নিজে ধরেননি। তাই বুড়ো বয়সে এই প্রচেষ্টায় খামতি রয়ে গেছে। আবার লজ্জা পান এই ভেবে যে এ হয়তো কবির অহেতুক অহং। কিন্তু সেটাই বা কেন? এই অহংটাই জীবনের সম্পদ যেটা না থাকলে যুদ্ধ জয় সম্ভব নয়। যেটা কবি পারেন সেটা করা হয় না। আত্মপ্রত্যয়ে অভাব ঘটে। এই বোধ থেকেই তো এই বয়সে কবির নিজেকে খুঁজে পাওয়া। অক্লান্ত পরিশ্রমে কবির আনন্দ। রাতের পর রাত জাগা। ভাবনাগুলো তখন জড় হয়। লেখা আসে কলমে। তারই ফসল এই কবিতাগুচ্ছ যা কবি পাঠক পাঠিকাদের উপহার দিতে পারেন। বলা চলে জীবন সায়াহ্নে এটাই কবির বিশ্রাম যেটা আগে পান নি। কবির জীবন ভাবনাকে তুলে ধরার চেষ্টা। নিজে একটা কবিতার সাহায্যে কবি এটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
কয়েকটি প্রকাশিত বই—
কবিতা: ১. গোধূলি, আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ২. ছোট্ট ছোট্ট ব্যথা।
ছড়া : ১. ছড়া ও ছবিতে শৈশব ২. ছড়া ও ছবিতে শৈশব ৩. উল্টোপাল্টা ( সবকটি কালি কলম ইজেল প্রকাশিত), ৪. টাগডুম বাগডুম, বাকচক্র পাবলিশার্স।
প্রবন্ধ ও বই : ১. পরবর্তী প্রজন্মের মুখোমুখি ২. লুট হয়ে যায় স্বদেশ আমার ৩. সংকটের সভ্যতা, ৪. বিক্ষুব্ধ এ ভারত, ৫. ভুখা অর্থনীতি (আন্তর্জাতিক প্রকাশনা) ৬. ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনীতি, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স ৭. ভারতের অর্থনীতি, মিত্রম ৮. Colonial Economy of India, বাকচক্র ৯. Plunder My Motherland, বাকচক্র।