ছোট গল্পঃ অস্তিত্বের শিকড়
অর্পিতা বোস
“বেয়াই মশাই আবার আসবেন। ভালো থাকবেন।”
দরজার বাইরে কথাগুলো কানে আসতেই পেছনে তাকায় সুশোভন। বেয়াই-বেয়ান দুজনেই হাত নাড়ছেন হাসিমুখে। সৌজন্যবোধে হাতটাও নাড়ে। নাহ্, রবি ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’র রামসুন্দরকে বোধহয় ফিরতি পথে এই সৌজন্যতাটুকু কেউ দেখায়নি। এই ক্ষেত্রে রামসুন্দরের থেকে অনেকটা এগিয়ে সুশোভন। তাছাড়া মুকুটের বিয়েতে দেনাপাওনাও ছিল না। কিন্তু অপমানটা? আবার কানটা গরম হয়ে গেল। কানে বাজছে বেয়াইয়ের কথাগুলো,
— আপনার মেয়ে মুকুট এখন আমাদের বাড়ির বউ। এটা ওর বিয়ের পর প্রথম জন্মদিন। আমরা একটা পার্টি দেব। সেজন্যই ওরা শপিং গেছে। পার্টিতে পরার ড্রেস, জুয়েলারি কিনবে। এখানের এত বড় অ্যারেঞ্জমেন্ট ছেড়ে কি করে আপনার ওখানে যাবে বলুন তো? তাছাড়া মুকুট তো বলল যে ওর জন্মদিনে কখনও পার্টি হয়নি আপনাদের বাড়িতে। এখানে একটা বিরাট আয়োজন। তাই ওর এখন তো বাপের বাড়ি যাওয়া চলবে না। নিন খাবার খান। এতটা এসেছেন, আবার এতটা যাবেন, এই ভরদুপুরে। এখন তো আর মেয়ের শ্বশুরবাড়ির জল খেতে নেই এই নিয়ম তো উঠেই গেছে। কী যে সব নিয়ম ছিল!
বেয়াইয়ের মুখের বিদ্রূপ মাখানো হাসিটাও যেন সামনের প্লেটে রাখা খাবারে ছড়িয়ে পড়ছিল।
2
লিফটে উঠতেই এতক্ষণের কষ্টটা চোখ ভরে আসে। ঝাপসা ছবি ভাসে লিফটের ভেতরে।
অফিস থেকে ফিরে দরজায় দাঁড়াতেই টলমল পায়ে দৌড়ে আসে ছোট্ট মুকুট। হ্যাঁ, মাথায় রাখবে বলেই মেয়ের নাম রেখেছিল মুকুট। আর সেই মেয়েকে জন্মদিনে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইতে এসেছিল আজ। নিজের সন্তানকে নিজের কাছে নিয়ে যেতেও অনুমতি চাইতে হয়! বাইরে না থাকলেও সুশোভনের চোখ জুড়ে আজ শ্রাবণমাস।
আর্থিক অসঙ্গতির জন্য সত্যিই মুকুটের জন্মদিনে কখনও পার্টি থ্রো করেনি । তবে একবার মহাজনের থেকে সুদে ধার নিয়ে মেয়ের জন্মদিনে একটা দামী জামা কিনেছিল। সাথে ছোট একটা অনুষ্ঠানও করেছিল শুধুমাত্র মেয়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তারপর মহাজনের হেনস্থার দৃশ্যটা ভাবলেই আজও শিউরে ওঠে সুশোভন। নারকীয়!
সেই অপমান আর আজকের অপমানে কতটা ফারাক?
মেয়েটার সাথে আজ দেখাও হলোনা। চোখ মুছে লিফট থেকে বেরিয়ে সাউথ সিটির রাস্তা ধরে সুশোভন।
৩
দোকানের নীল ড্রেসটায় বারবার চোখ আটকে যায় মুকুটের। নীল রঙটা বরাবরের খুব পছন্দ। মনে পড়ছে ছোটবেলায় একবার বাবার সাথে কলকাতা এসে একটা দোকানের শোকেসে রাখা নীলরঙের জামা দেখে বায়না করেছিল। বাবা সেবার জন্মদিনে সেই জামাটাই নিয়ে এসেছিল।
নিজের পছন্দ আর বাবার গল্পটা বলতেই হো হো করে হেসে ওঠে সায়ন।
–এত সস্তা তোমার পছন্দ!
মুকুটের ইচ্ছের কোনো মূল্যই থাকেনা সায়নের কাছে। আর এমনি ভাবেই সায়ন মুকুটের পোশাক কিনল নিজের পছন্দে।
তাই বলে কি সায়ন ভালোবাসে না মুকুটকে ? বরং মাত্রাতিরিক্ত সায়নের ভালোবাসা মুকুটের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে।
এই তো সেদিন সায়নের পাশে বসে টিভির একটা সিরিয়াল দেখছিল। নায়িকা দৌড়ে তার দাদাকে জড়িয়ে ধরে। টিভির এই দৃশ্য দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিল মুকুট। চিকচিকে চোখে সায়নের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,
–ভাইবোনের কী সুন্দর সম্পর্ক দেখো!
গম্ভীর হয়ে উঠে গিয়ে ফ্যানের রেগুলেটরটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সায়ন। ওখান থেকেই কেটে কেটে বলেছিল,
— মেয়েদের এই ন্যাকামিগুলো আমার একদম পছন্দ না। স্বামী ছাড়া আর কোনো পুরুষকে কোনো বিবাহিত মহিলা জড়িয়ে ধরা উচিত না।আমি ছাড়া আর কোনো পুরুষকে তুমি জড়িয়ে ধরবে আমি ভাবতেই পারিনা। সে যেই হোক না কেন।
অবাক মুকুট প্রতিবাদের ভাষাও ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু বাবা অফিস থেকে ফিরলেই বাবাকে জড়িয়ে ধরত মুকুট। তবে কী বিয়ে হলে সবকিছুই বদলে যায় ?
৪
গাড়িতে উঠে এসির নবটা বাঁদিকে ঠেলে দিল মুকুট। যাতে ঠাণ্ডাটা বুকে না লাগে। কানে তখনও ঝাঁক ঝাঁক বর্শার মতো ছুটে আসছে সায়নের বিদ্রূপের হাসিরা,
–রূপোর গয়না পছন্দ করে সামর্থ্যহীন মানুষেরা। ডায়মন্ড সেটটা দেখবে অনেকেই জেলাস হবে।
কথাগুলো শুনে মুকুটের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা পুরনো ছবি।
বাবার দেওয়া রূপোর নূপুর পায়ে ঝমঝমিয়ে হাঁটছে মুকুট। তাই দেখে বাবা বলছে,
— এভাবেই তোর পায়ের ঝমঝম শব্দে আমার বাড়িতে আনন্দরা গমগম করবে।
সেই রূপোর নূপুরের শব্দের আনন্দ কি ম্লান হয় হীরের নেকলেসের ঝলকানিতে? আলতো হাতে চোখ মোছে মুকুট। আজ খুব বাবার কথা মনে পড়ছে। কতদিন দেখা হয়নি বাবার সাথে।
সায়ন একদম যেতেই চায়না সিঁউরি। ও বাড়িতে কমোড আর এসি নেই । তাছাড়া দ্বিরাগমনে গিয়ে রান্নাঘরে চারটে আরশোলা দেখেছিল সায়ন। সেই প্রথম আর শেষ সিঁউড়ি যাওয়া। কিন্তু বাবার গায়ের ঘামের গন্ধটা যে মিস করে মুকুট সেটা সায়ন বোঝেনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকায়। ঐতিহ্যের সাউথ সিটি চোখের সামনে। আর সেই রাস্তায় এক পরিচিত অবয়ব দেখে চমকে উঠল। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অত্যন্ত ধীরে হেঁটে আসছে বাবা। ঘামে সারা গা ভেজা। মুহূর্তে বাবার গায়ের সেই অত্যন্ত প্রিয় চেনা ঘামের গন্ধটা যেন নাকে এল। সারাটা মাথা ওলোটপালট । দুম করে গাড়ির কাচ নামায়।উত্তেজনায় স্টিয়ারিং এর ওপর হাত রাখে। ঘাড় ঘুরিয়ে অস্ফুটে বলে ওঠে,
— বাবা।
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে সায়ন ব্রেক কষে,
— ননসেন্স। রানিং গাড়ি এভাবে থামানো যায় না।
৪
মেয়েটার সাথে দেখা না হলেও এবাড়িতে মুকুট বেশ ভালোই আছে বোঝা যায়। এতবড়ো বার্থডে পার্টির আয়োজন! সত্যিই মেয়েটার তেমন কোনো সখ-আহ্লাদ পূরণ করতে পারেনি সুশোভন। অনেক ছোটবেলায় একটা জামা আর রূপোর তোড়ার বায়না ছাড়া কখনওই কিছু চায়নি। যাক এবার ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করুক। তবুও কতদিন হলো মুকুটকে দেখেনি সুশোভন। চোখের জলটা মুছতে রুমাল বের করে। চোখ মুছে সামনে এগোতেই অবাক হয়ে দেখে গাড়ি থেকে নামছে মুকুট। আপনমনেই হাত দুটো মেলে দেয় সুশোভন। মুকুট ছুটে এসে জড়িয়ে ধরবে বলে।
৫
হাতের হীরের সেটের ব্যাগটা সিটের ওপর রেখে দরজা খুলে নামে। ঝাপসা চোখে দেখে সামনে দু হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছে বাবা। ঠিক যেমন অফিস থেকে ফিরে দাঁড়িয়ে থাকত। দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরত মুকুট। আজও তেমন করেই বাবাকে জড়িয়ে ধরতে এগোয়। ঠিক তখনই মনে পড়ে সায়নের কথা,
“আমি ছাড়া আর কোনো পুরুষকে তুমি জড়িয়ে ধরবে আমি ভাবতেই পারিনা। সে যেই হোক না কেন।”
থমকে যায় মুকুট। দৌড়োতে পারেনা। হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যায় বাবার কাছে। দু হাত মেলে রাখা বাবার হাতদুটো একসাথে করে হাতে হাত রাখে। সূর্য তখন মধ্য গগনে।
অবাক সুশোভন থমকে যায়। আদর করে কাছে টেনে নিতে পারেনা তার একান্ত প্রিয় আত্মজাকে। হাতের ওপর হাত রেখে বাবার চোখের দিকে তাকায় মুকুট। দেখে বাবার চোখে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে বন্দরহীন নিরুদ্দিষ্ট কোনো এক জাহাজ। ডুকরে কেঁদে উঠতে গিয়েও কান্নাটাকে এক ঢোকে গিলে নেয় ।
মধ্যদুপুরে দাঁড়িয়ে মুকুট বুঝতে পারল তার অস্তিত্বের শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছে সিঁড়ড়ি থেকে। এই শিকড় এই শহুরে জীবনের মাটিতে প্রবেশ করতে পারবে কি? না, জানা নেই…
মেয়েদের জীবন…
কলমে- অর্পিতা বোস