“পঞ্চকাব্য”
—মৃদুল সাহা
কাব্য—১
বাদামি অসুখ
উনুনে তুষ ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখে
গাঁয়ের যেই পল্লীবালা সে আমার অনেক কালের চেনা।
শরীরে তার সিদ্ধ ধানের ঘ্রাণ–হাতে চাল ধোঁয়া
মুখে তার
শিশির ভেজা স্নিগ্ধ ঝিঙে ফুলের হাসি
মুক্তো দানা রাশি রাশি
সলাজে ঘোমটা টানা
আঁধারে কুপির আলোয় কাঁপা কাঁপা শিখা
আজন্ম স্নেহে মনে পড়ে মায়ের কথা—এই বাংলা আমার প্রিয় স্বদেশ ।
যাকে হারিয়েছি–
নাড়ীতে সে আজও স্মৃতিময়
ক্ষমাহীন বধির নির্বিকার !
মনে পড়ে
তিরিশ পেরোতে না পেরোতেই
হারিয়েছিলাম গণতান্ত্রিক অধিকার !
কষ্টার্জিত সনদ গুলোতে নেই মহত্ত্বের অহংকার !
রাষ্ট্রের মূলধনে আমার অধিকার
ষোলআনায় শূন্য কোটা !
দিন বদলের জারি গানে
বদলে গ্যাছে আমূল,শিল্প, সংস্কৃতি
আচার বিচার
মাঝ রাতে অন্ধকারে গলির কুকুটার
করুণ চিৎকার শুনি !
সরু রাস্তটা এখন অনেক প্রসস্ত হেঁটে গ্যাছে
শহরের অভিমুখে ছুটে গ্যাছে নতুন আশায়
দুপাশে বিপনি বিতান
রাস্তার বাতিগুলো জানে না আঁধারের পরিমাপ !
হারিয়ে ফেলেছি পৈত্রিক জন্মভিটে
নতুন সামন্তবাদের দখলে আজব শহর !
কাটা গ্যাছে প্রাণের প্রিয় বটতালার ছায়া,
বুড়ো বাউল দরবেশ মরে যাওয়ার পর আর শুনি না
ফকির লালনের সুর ”
বাড়ির পাশে আরশি নগর” !
মনের বার্ধ্যকে ভুলে গেছি বিপ্লবের স্লোগান গুলো,
ভুল নামের নাগরিক সনদটা
মাঝে মধ্যে উপহাসের তুড়ি মারে
তখন বুকের ভিতরটায় ককিয়ে উঠে
একটা বাদমি অসুখ !
———–
কাব্য–২
শূন্যের ঠিকান
এত দূরে ছিলে
দেখতে পাইনি তোমায়
শুধু ছায়াময় —
শুধু শব্দের তরঙ্গ
এক নদীর জল-
এটুকুই পরিচয় !
ছিল কত মেঘবেলা
বাদল ঝরা দিন
কোথাও ছিল না কেউ —
কত বসন্ত কেটেছে
দেখিনি ফুল ফোটা
শুধু বালিয়াড়ি ঢেউ !
তুমি ছিলে কল্পনা,
কত জন্মের স্মৃতি কথা
কবিতার পাতায়–
কত মৃত্যু দেখছি
চিহ্ন হীন সৎকারে
অপমৃত্যুর মতো বিদায় !
ঘুম ভাঙা রাতে
দেখছি মৃতের মতো
শীতল শিয়র–
নিঃসঙ্গ চাঁদ মলিন,
ঘুমিয়েছে সব পৃথিবীর,
ভেসে গেছে লক্ষ্মীন্দর !
জেগে জেগে দেখেছি
অনেক অনেক রাত
আকাশের হৃদপিণ্ড থেকে —
ঝরে গেছে উল্কা
হাজার কোটি নক্ষত্র
শূন্যের নীল ছাই বুকে !
আকাশটা ছিল অয়োময়
বন্দি হাওয়ার বিলাস
কত ভুলের ছলনা–
আঁধারের ঘ্রাণ সেঁচেছি
নোনা হ্রদের পাড়ে
পাইনি কোন ঠিকানা !
————-
কাব্য–৩
অপেক্ষার পদধ্বনি
কোথাও সুখের ছোঁয়া নেই
ধোঁয়ায় ঢাকা পৃথিবী
এই আকাশ মাটি জল—
সবই আছে আগের মতো
তবু কি যেন ছিল
কি যেন নেই–ধূধূ বেলা
শূন্য খেয়ালে কেবলই ভুলি
শোক ভুলে গেছে
না পাওয়ার কষ্ট গুলো
পাওয়ার আনন্দ গুলো হারিয়ে
গেছে,
যেন অনন্ত কালের খেয়ার পাড়ে
কোন স্মৃতির পাখি–!
মায়া হরিণী আজ অন্ধ
স্তব্ধ নীল ঠোঁটে তার
বিষময় যৌবনের ভগ্ন বিলাশ
রাত কলিদের কাছে রেখে যায়
কষ্টের মিনতি—-!!
উড়ো খবরে ভেসে যায়
স্বপ্নরা–কোন ঠিকানা রাখে না
রাতের গভীরে ঝিঁঝিদের শব্দ
একটানা—আঁধারের প্রহর মাপি
মাঝ রাতে অশরীরী
ছায়ারা শুভ্র কাফনে ঢেকে দিয়ে
যায় ছোট নদীর সুর–
কিছু কথা চিঠির ভাষার মত
রেখে যায় শিয়রে–
নির্জন শ্মশানের মৌনতার মত
কিছু কথা
তাজা ধূপের গন্ধে অতৃপ্ত
আত্মাদের দীর্ঘশ্বাস
রচিতে চায় অমর কবিতা !
অসহায়ের মতো সব দেখি
অবিরাম শুধু শুনে যাই-
অজানা অপেক্ষার অক্লান্ত পদধ্বনি —-
——-
কাব্য–৪
দায় মুক্তি হীন বিদায়
হৃদয়ের স্পর্শ গুলো হারিয়ে গেছে
শুধু একলা চলা
ঘন মেঘলা আকাশ তলে–
সমুখে সমুদ্রের গর্জন
রোষে ভরা ঢেউের শব্দ
শুনি অবিরাম–
বুঝিনি হারিয়েছি পথের সীমানা
সাগর লতা পা জড়িয়ে ধরে
কি যেন বলিতে চায় —
কবিতার ভাষায় !
তাদের আকুলতা দেখেছি
আমি আজ নিঃস্ব —
ঘূর্ণি পাকে হয়েছি বিলীন,
বালিয়ারীর শো শো উড়ে যাওয়া
ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি
মেঘের আঁচল দেখে মনে পড়ে না –
এখন আর চোখে ভাসে না
প্রেয়সীর কাজল কথা —
পথ হাঁটি ক্ষীপ্র গতিতে
তবু ফুরায় না পথ
মনে হয় দাঁড়িয়ে আছি স্থীর
কোন অদৃশ্য দানবের কুহক !
মায়াবী আঁধার নামে
আলেয়ার আলোরা খেলা করে
ফানুষের মতো মিছে খেলা
জোছনা খোঁজা শুধুই নিরাশা !
হিমেল হাওয়ায় ভেসে আসে
মহা শ্মশানের নীরবতা
কোথা ও কেউ নেই —
শূন্য স্মৃতির মিনার
মৃত অনুভূতি গুলো সোঁদা ফেনার
মতো ভেঙে যায়
তাদের কাতর আর্তনাদ শুনি
সকরুণ দায় মুক্তি হীন বিদায় !!
———
কাব্য–৫
সম্পর্ক
কোন একদিন বিস্তীর্ন শ্যামলিমায়
অনেক দূরে,দিগন্ত সীমানার পারে,
দাঁড়িয়েছিলে সে,মাতৃহারা গো-শাবকের মতন
কাজল লতার মতো উদাস,বিজন ঘাসের নীড়ে-।
কিছু কিছু মেঘেরা তখন জমে ছিল
অস্তরাগের বিদায়ে তখন নির্জন আকাশ,
বড় ভারাক্রান্ত,অজানা কিছু বেদনা তার
চোখের কোনে,মুখে ছিল একটি ছায়া দীর্ঘশ্বাস।
অপেক্ষা গুলো প্রহর গুনে,অখণ্ড নিরবতায়
ঝরে পড়ে শুকনো পাতারা,জ্বলে সাঁঝের প্রদীপ,
জীবনের কিছু কথা তখন স্মৃতি হয় নিঃশব্দে
ঘনায়িত আঁধারে বিলীন পৃথিবী যেন মায়ার দ্বীপ।
আত্ম-জিজ্ঞাসায় একটি প্রশ্ন ভেসে আসে
বারে বারে, খুঁজি সম্পর্কের বাঁধন আমার তাহার,
জাগতিক ভাবনা গুলো কেমন যেন মনে হয়
বিচ্ছিন্ন হতে থাকে, হৃদয়টা কেবলি হয় অসাড় !
———০——–