কাব্য—১
==তুমি ও আমি==
==মৃদুল সাহা ==
অপরিমেয় রহস্যের জালে আমি
জড়িয়ে থাকি তোমার সাথে
তুমি যে আমার বন্ধু হও
তুমিই আমার প্রীতি–
তোমার জন্য আমি শতদল হই
হেমন্তের শিশির ভেজা
উদাস দুপুরে আমি বাউল হই
একতারায় সুর তোলা
তুমি নদী তুমি নারী
তুমি আমার আনন্দ বেদনার কাব্য স্মৃতি।
বিকেলের আবির মেঘে
আমি তোমার জন্য যাযাবর হই
বউ কথার সুরে
কিশোরীর সরল চাহনিতে আমি
তোমাকেই খুঁজি
সন্ধ্যার চিলেদের নরম ডানার
সোঁদা গন্ধ হই।
বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণ সন্ধ্যায় তুমি
বনফুলের ঘ্রাণ —
নিঃসঙ্গ রক্তকরবীর দোল
আমার জানালায় —
আমি ধূপের সৌরভ হয়ে ভাসি !
মধ্য রাতের ঘন জোছনায় মাখা
শরীরে তুমি আমার প্রেয়সী হও
অভিমান ভাঙা চোখের জলে
মোহনীয় চুম্বন ;
মৃদুল দোলে মাটির প্রদীপের শিখার মতো
চুপিচুপি কথা বল,
ভালবাসার আবেগ স্পন্দনে
নিষ্পলক চোখে হাজার কথার ভীড়।
দিন শেষে তুমি আমার
ঘরে ফেরা ভাসান মাঝির উদাস কন্ঠ–
মন কেমন করা ভাঁটিয়াল
নাওয়ের তলে ছলাৎছলাৎ
ছন্দ তোলা বেভুল ;
তুমি আমার দীর্ঘ শ্বাসের
বিমূর্ত কায়া
নিবিড় আলিঙ্গনের স্বপ্ন স্পর্শ
আমার সব চিঠি তোমাকেই লেখা
সুরের স্বরলিপি
বিরহের অশ্রুজল !
————-
কাব্য—২
শিরোনাম–অনর্থের অভাব
কলমে–মৃদুল সাহা
শূন্যতেই শুরু শূন্যতেই শেষ
এই কথা নিয়ে ভাবি না বিশেষ
ভুলে যাই সব–
চলছি সবে যে যার মত
ভাবি না সহজে অতশত
আত্ম চিন্তায় নীরব।
গড়ে যাই আপন পৃথিবী
যা আছে নিজের স্বপ্ন ছবি
তাই নিয়ে মগন–
কখনো জয় কখনো পরাজয়
দিন শেষে হোক না যা হয়
সুখ বা দুখ যেমন।।
গুছিয়ে রাখি নিজেকে নিজে
স্বার্থ ছাড়া মন না ভিজে
এটাই একান্ত বোধ–
আপন মরমে লাগিলে ঘা
প্রতিঘাতে হই না পিছু পা
মনে আগুন প্রতিশোধ !
শূন্য হৃদয় বিরান পটভূমি
বিবেকের বাণী আছে ঘুমি
কে জাগাবে কাকে–?
কোথায় আছে সেই দীপশিখা
আঁধারে পথে আলোর রেখা
মিনতি ভরে ডাকে !!
গলিত বুঝি এই মানব সত্তা
কতটা ধরছে পচন নেই ইয়ত্তা
কে করে তার হিসাব –?
আছে যাদের ক্ষমতা বেশি
তারাই করে কাজ বেশি অবিশ্বাসী
অনর্থেই কত অভাব !!!
———
কাব্য—৩
শিরোনাম–গন্তব্য নিখোঁজ
কলমে–মৃদুল সাহা
জীবনের ওঙ্কার নির্লিপ্ত,
ব্যাগ ভর্তি বায়ু দূষণ ফুসফুসের
জানালায়
গলিত লাভার মতো সত্তার রক্ত
ক্ষরণ দেখি অবলীলায়,
কর্পোরেট আলোর আধো অন্ধকারে
ডুবে থাকে এক ক্ষুধার্ত কঙ্কাল,
একটা তথৈবচ সিনেমার মতো
বিরতি হীন,
মূলবান একঘেয়েমির আবেগ !
রং চশমার নীলচে ফ্রেমে
উচ্ছিষ্ট অনুভব –উদ্ভট তামাশা
খেলা নিজের সংগে নিজের
মুখ গুজে পড়া থাকা হাপিত্যেশ !
রঙিন মোড়কে বন্দী থাকে
এক দলা আকাশ
চাপ চাপ অন্ধকার চুইয়ে পড়ে
মিশে যায় জীবনের স্রোতে
যখন তখন —
কালো কালো –নিস্তব্ধ স্বরে
স্বগতোক্তিক বাতাবরণ !
বিস্তর অভিসন্ধিতে চারপাশ
কাঁটা লতার মতো জড়িয়ে ধরে
বড্ড অচেনা,
জ্যামেতিক বলয়ে বেড়ে উঠা বসয়,
সুনিপুণ অভিজ্ঞতায় প্রতিদিন
জীবন যেন এক দীর্ঘায়িত বিনিয়োগ,
শব্দ হীন পায়ে পায়ে
হেঁটে যায় একা এক মিছিল
গন্তব্য নিখোঁজ !!
———
কাব্য —৪
==সময় ফুরিয়ে যায়==
==মৃদুল সাহা ==
বসন্ত ফুরিয়ে যায়
পাখিরা বিরহে গায়
ফুল পাতা ঝরে—
জীবন ফুরিয়ে যায়
সময় রহে না ঠায়
বয়স কি আর বাড়ে ?
নদী বহে যায়
কত কি ভেসে যায়
কত কথা তার বুকে—
কেউ না জিজ্ঞেসে তায়
আপনারে লয়ে সবায়
কে কাঁদে কার দুখে !!
জীবন এক জ্যান্ত খেলনা
দমে দমে আশা বাসনা
থামতে চায় না কখনো —
দু’চোখে পদ্মা মেঘনা
হাসি ব্যথা কত ছলনা
শুধুই করে বাঁচার জন্য।।
দিন যায় রাত আসে
কর্ম শেষে ঘুমের বসে
স্বপ্নের ভাঙা গড়া —
জীবন শেষে মৃত্যু আসে
চোখের জলে নিঃশেষে
বিদায় চিরতরে নীড় হারা ! !
———–
কাব্য —৫
শিরোনাম–বন্ধু
কলমে–মৃদুল সাহা
বন্ধু তুমি বসন্তের লগ্নে এক ঝলক
বুনো হাওয়া,
নিশিকান্নার করুণ শিশির জলে
স্নিগ্ধ শুদ্ধ ভোর–
খড়ের মাঠে নগ্ন পায়ে একা একা
হেঁটে যাওয়া,
ফসলের মাঠের আলে বীজন বটের
ছায়া দুপুর।
সবুজ ঘাসের চোখে আকাশের
খোলা নীল চুল,
মেঘের পালকে পালকে বিকেলের
সোনা রোদ —
হাজার বছরের মুগ্ধতায় মায়াবী
আদরে ব্যকুল,
দিগন্তের বিস্তৃত নরম আঁধারের তখন
চাঁদ অবোধ।
সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা হাঁসেদের শরীরে
থাকা গন্ধ,
পানা ফুলে জলে ভেজা সিক্ত স্নেহময়
আকুলতা —
প্রদীপের শিখা চিরন্তনী,কূল বধূদের
শরীর ছন্দ,
ধূপের সৌরভে মিশে কড়ইফুলের
গন্ধ মাদকতা।
শেষ বিকেলের বিষাদ দূরের দিগন্তে
শিমুলের বন,
ঘরে ফেরা পাখিদের ডানায় ক্লান্ত
দিনের বিশ্রান্তি–
প্যাঁচাদের অলস ওড়াউড়িতে দিবা
রাত্রির সন্ধিক্ষণ,
ফিকে আলোতে কালো দীঘির জলে
স্তব্ধ প্রশান্তি।
জোছনার হিরন চোখ দেখিয়াছি এইসব
মায়াবী আদর,
কুপির আলো জ্বলে কিশোরী হাতে
ধিকিধিকি আগুন–
পাখির ছানাদের আকাঙ্ক্ষার মতো
বিষন্নতায় কাতর,
চিরদিনের স্মৃতির মিনার ঝরাপাতার
শব্দে ফাল্গুন।।
—————-