ফেলে আসা গ্রাম
কলমেঃ- মোঃ এনতাজুর রহমান
ওগ্রামটা কি অমনি আছে?
ছোট্ট নদীর বড় বাঁকে মাঠে ঘেরা
পদ্মবিলের মাথার কাছে……..
টিন খড় বা ছনের মাথাল মাথায় চেপে
কাদামাটি নোয়ানো ঘর হেথা হোথা
হাজার গাছের খাড়া মাথা
মন্দ হাওয়ায় বাঁশের পাতা দুলে দুলে নাচে
ওগ্রামটা কি অমনি আছে?
দুইবেলা দু’মুষ্ঠি ভাতে পেটের দহন নিভিয়ে দিতে
ছাড়ছি সোনার ওগাঁও খানি
হার মেনেছি কঠিন খেলায় রুদ্র ক্ষুধার সাথে;
ওগাঁওটিরে ফেলছি পিছন পাশে
ওসে কঠিন রাসে দূরে বসেই ভিজায়ে চোখ
আজও টানে কাছে
ওগ্রামটা কি অমনি আছে?
এখনো কি সপ্তাহ গুণে দুই বাসরে
হাট বসে ঐ মিঠেধারা নদীর ধারে
সারে সারে হাটুরে সব ছুটে আসে কলরবে
বিকিকিনি শেষে বাসে ফেরার উৎসবে
গলা জড়ে দড়ি বাঁধা তেলের শিশি ঝুলিয়ে হাতে
সদাই ভরা ঝাঁকা ঢাকি ভামা ছালা ঘাড়ে মাথায়
ধুলা মেড়ে ছুটে বাড়ির পথে
পানসি ভিড়ে নদীর ঘাটে
উড়িয়ে ধুলো মাটির বাটে
গো-মহিষের বোঝাই গাড়ি আসে কি ঐ হাটে
বট-শিমুলের তলে ভাঙ্গা মঠের কাছে?
ওগ্রামটা কি অমনি আছে!
এখনো কি ডাকলে শেয়াল রাতদুপুরে
ঘুমের শিশু মায়ের বুকে
আঁৎকে উঠে মুখ লুকায়ে অন্ধকারে জড়িয়ে ধরে
চমকে উঠে ডাকলে প্যাঁচা বড় তেঁতুল গাছে!
ওগ্রামটা কি অমনি আছে?
এখনও লজ্জা-ভয়ের বোধ জাগেনি প্রাণে
গুটি গুটি পায়ে ছুটে কৌতুহলের টানে
ঘরের পাশে মায়ের কাছে ফেরে পায়ে পায়ে
ধূলি কাদায় লুটিয়ে হেসে ফুটে আদুল গায়ে
তারা আজো কি সব আড়াল পেলে
বাড়ির নজর পায়ে ঠেলে নদীর ধারে ছুটে চলে
অভয় প্রাণে দীঘির ঘাটে করতে কেলি নামে জলে
চাপড়িয়ে জল ঘোলা করে হেসে-কুটে নাচে?
ওগ্রামটা কি অমনি আছে?
ঐ যে ঝাকড়া বোঝা এলো চুলে ঘন কাজল মাখা
তাই মাথাতে বয়ে বেড়ায় কিশোরিটা হরিণচোখা
মাঠে পথে আলে আলে ছুটে বেড়ায় নেচে দুলে
ঘাগরা-ফ্রকে আদুল পায়ে ছোট দলে,একা একা!
কেউবা বলে দুষ্টু পাজির শিরোমণি
কেউবা বলে দস্যিরাণি
কেউবা বলে গাঁয়ের লক্ষ্ণী কেউ হেসে কয় বোকা!
তার ডাগর চোখের কাজল ছুঁয়ে মাখলে মেঘের গায়ে
ঘনিয়ে আঁধার কালবোশেখি বেগে আসে ধেয়ে
বুক ধড়াসের ঝড় উঠে যায় যুবা-ঋষির প্রাণে!
উষ্টা খেয়ে হুমড়ে পড়ে—চোখ ফেরেনা পথের টানে
চোখ মিটায়ে হেসে দিলে,করলে অধর বাঁকা।
মিঠে রোদে ফাগুন বেলার শেষ বিকেলে
ঘন কালো কুন্তলে তার জড়িয়ে বাঁধা ভাঁটের ফুলে
বেণীর পাকে গড়িয়ে দুলে ধবল গোখুর ফণা তুলে
দু’গোছা ভাঁট হাতে নিয়ে ধূলি মাখা আদুল পায়ে
মুর্তি সাজে দাঁড়ায় মাঠের মাঝে
আলপথে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা জোড়া তালের ছায়ে
পুষ্ট-পাকা সর্ষে ক্ষেতের ধারে দূরে চেয়ে একা একা
কী জানি কার পাবে বলে দেখা!
আজো কি সে দাঁড়িয়ে থাকে নোলক প’রে
উদাস চেয়ে মাঠের পানে মরা দীঘির কাছে?
ওগ্রামটা কি অমনি আছে!
রাম বাদাড়ের গা ছমছম তেঁতুল গাছের তলে
পদ্মবিলে মন্দ ঢেউএর নিটোল গভীর জলে
ভেলা ঠেলে দস্যিটা কি ছুটে বিলের মাঝখানে
পদ্ম শালুক ভেঁট গুলো সব দখল নেয়ার অভিযানে
চেলারা কি তোয়াজ করে যোগ্য গোদার সম্মানে?
ভুতের দীঘির পূর্ব পাশে বিঘে বিশেক জায়গা জুড়ে
শ্মশাণ ঘাট আর অগম ঝোপে নিত্য কি তার চরণ পড়ে
শ্মশাণ ঘাটে সার বেসারে আপনা হতেই উঠা বেড়ে
বেওয়ারিশ বেল চালতে জাম্বুরা জাম চুকা বরই
হইছে কি তার হাতছাড়া?
মাঠের শসা বাঙ্গি ক্ষিরে বাঁশের বাতার ঘিরে বেড়ায়
কঠিন বূহ্যে নিরাপদ কি!
ঐ দস্যি দলের নজর এড়ায়?
ওরা কি দল বেঁধে সব সাতসকালে
টুকরি মাথায় ছুটে চলে ফুল কুড়াতে শিমুল তলে
হালের বলদ,দুধেল গাইটা খাবে বলে!
শরৎ কালের প্রভাত বেলায় ছুটে দলে বকুল তলায়
ভিজিয়ে দু’পা শিশির জলে রাঙ্গিয়ে ধূলি কাদায়
হিজল নাটার ডালে ডালে
মাঠের মাঝে ক্ষেতের আলে আলে
সর্ষে ফুলের হলুদ মেখে ছুটে চলে শিশির ধোয়া পায়ে
শুকনো নদীর পাড়ে পাড়ে লুটে পড়ে যায় গড়ায়ে
সরু সোতার বিঘত নিটোল জলে
ঘোলা করে কাদা ছুড়ে কুটিয়ে হাসে কলরলে?
মধুমাসে সকল বারন পায়ে ঠেলে চুপি চুপি ছুটে
লবন ঝালে চটকে কি খায়
কলার পাতায় চুকা কাঁচা আমগুলো সব কুটে?
আজো কি সেই চৈত্র মাসের দুপুর কালে
দস্যিরা সব চুপি চুপি ঘর পালিয়ে জুটে এসে দলে
মাঠের পাশে ঘন ছায়ার বড় বটের তলে
চৈতা ক্ষেতের শুকনো ঝুনা বুট খেসারি মটর তুলে
পুড়িয়ে খায় শুকনো নাড়ার নুড়াই জ্বেলে জ্বেলে
হেসে লুটে ছড়িয়ে ছিঁটে মুখে গায়ে ছাইগুলো সব সেটে
ভূতের সাজে দীঘির জলে নাইতে চলে ছুটে?
পথের ধারে দাদি-নানী-বৌদি-দিদি কারেও পেলে
জড়িয়ে ধরে দু’হাত মেলে খিলখিলিয়ে
ছাই কালি সব মাখিয়ে দিয়ে ছুটে পালায় ঠেলে।
ঐ শুচিবাই ফোঁকলা দাদী লাঠির গুঁতো পথের পরে ঠেসে
চেঁচিয়ে উঠে মাঠ কাঁপায়ে মনে মনে হেসে,
“ওরে ধাড়ি ঢেঙ্গি ছুঁড়ির দল এতো মাইনষি মরে
তুরা ক্যানে মরিসন্যারে রোদে ঠাডা পড়ে?
কয়্যা দিব সব কথা তুর মার দেখাটা পাই আগে—
মাইয়াডা যে ধাড়ি হইছে পাইছে জোয়ান রোগে।
তুর বাপ-মাক বলে গ্রাম ছাড়া তুক কইরব আগে থাম
ভাতার-বাড়ির লাটির গুঁতোয়
গইড়বে চোখের পানি ঝইরবে গায়ে ঘাম
বুঝবি তখন মজা—ভুলবি বাপের নাম!
এই চেংড়ি গুল্যা ডাঙ্গর হয়্যাই গাঁয়ের আপদ যত!”
দস্যিরা সব ছুটার পায়েই বলছে তাদের মত—
“বইল্যা দিয়্যা থইল্যা পাবি
বিষ্ঠা মাখা পান চিবাবি
গন্ধ পেলে নাক সিটকে বলবি ওয়াক থু!
খা বুড়ি তুই হাপুস হুপুস কালো বিল্যার গু—-
মোদের তাতে কী?
তুই যে বুড়ি ফোঁকলা কুঁজি কুটনি বাড়ির ঝি!”
“ছিছিছি!এই ধাংড়িগুলান কোন বাদাড়ে নোংরা মেড়েছে
ছুইট্যা আইসা আবার আমাক নেড়ে পালাইছে
পালালি ক্যান ওরে মুখপুড়ির দল—একবার যদি ধরি
দেখবি মজা,ঠ্যাংগুল্যা সব কেমন গুড়া করি!”
আস্ফালনের অতো কথা
শোনার সময় ওদের কি আর আছে!
ঝাঁপিয়ে পড়ে ততক্ষণে দীঘির জলে নাইতে নেমে গেছে
ও গ্রামে কি আজো অমন আছে?
আম জাম আর তেঁতুল বরই ঢিল ছুড়ে কি গাছে চড়ে
অবাধে কি লুকিয়ে চুপে দস্যিরা খায় পেড়ে?
তরতরিয়ে খেজুর গাছে লাফিয়ে চড়ে কাঠবিড়ালির পায়ে
গাছ ঝাঁকিয়ে ঝরা খেজুর নিচে এসে খায় কুড়ায়ে?
সারা গাঁয়ে পাড়ায় পাড়ায় ছুটে
সকল ঘরের গরম খবর সবটা নিয়ে লুটে
বিলিয়ে বেড়ায় ঘরে ঘরে বটের তলে দীঘির ঘাটে।—-
কার গোয়ালে গাই বিয়োলো কার ঘরে কোন কুটুম এলো
কাদের কাদের ঝগড়া হল কোন দেওয়ানী থামিয়ে দিল
কে আজকে বউ পিটালো—-কী সে কসুর ছিল।
কার বউটা রাগ করে আজ গেছে বাপের বাড়ি
কার বিয়েটা ভাঙ্গালো কে তাতেই মারামারি
শাউড়ি বকা দিল আজি কোন বউটাকে।
কবি পরিচিতিঃ
নামঃমোঃএনতাজুর রহমান।
জন্ম,শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ
রাজশাহী জেলার দুর্গাপুর উপজেলার অজো পাড়াগাঁ দাওকান্দি গ্রামের মধ্যবিত্ত গৃহস্থ কৃষক মৃত নছির উদ্দিন কারিগরের ঘরে ১৯৬৫সালে ২৫ সেপ্টেম্বর জন্ম এগারো সন্তানের ষষ্ঠ সন্তান।প্রাকৃতিক পরিচর্যায় মাঠ,বিল,ছোট বারানয় নদীর বন-বাদাড়ের ধুলা-কাদা-জলে বেড়ে উঠা।দাওকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়,উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজেই কাটে শৈশব, কৈশর ও তারুণ্যের সোনালী দিনগুলো।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের ছাত্র হিসেবে কাটে যৌবনের আট বছর।রাজনৈতিক ডামাডোলে চার বছরের কোর্স আট বছরে শেষ হলে চলে আসেন নীলফামারী পিটিআই সাধারণ প্রশিক্ষক হিসেবে।সরকারী চাকুরে হিসেবে বিভিন্ন জেলা ঘুরে বর্তমানে আবার নীলফামারী পিটিআইতেই সহকারী সুপারিনটেনডেণ্ট পদে কর্মরত।
সাহিত্য চর্চাঃস্কুল জীবনে মাঝেমধ্য কতিতা লেখা ।সপ্তম শ্রেনিতে পরীক্ষার খাতায় কবিতা লেখায় শিক্ষকদের মধ্যে দ্বিমুখী ঝড় উঠে,নাস্তানাবুব হয়ে পরের যত লেখা গোপনে রাখেন।মাঝেমধ্যে দু’এক ঝিলিক যা বেরিয়ে এসেছে তা সুখকর নয়।অবসরে লেখাগুলো পড়ে আনন্দিত হতেন—নাহোক প্রকাশ।একদিন হয়ত জানবে অনেকে।অগোছালো হলেও কবিতাগুলো ট্রাঙ্কে জমা থাকত। গোপন সাহিত্যচর্চায় চরম আঘাত আসে ১৯৯১ এর ১৪ ফেব্রুয়ারী।নীতিজ্ঞানহীন রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তে নারকীয় ছাত্রসংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হল সহ কয়েকটি হলে অগ্নিসংযোগ ঘটে।নিরাপদ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পুতুল নিরাপত্তা বাহিনী পুড়ে যখন শেষ হয় বীরদর্পে এসে উদ্ধার করলে শুধু প্রাণে বেঁচে লুঙ্গি আর একটা শার্ট পরে বাইরে আসেন।অনেক কিছুর সঙ্গে পুড়ে নষ্ট হয় আগলে রাখা ট্রাংকটি।দুঃখ ক্ষোভ মনোকষ্টে লেখা বন্ধ হয়ে যায়।শুধু প্রাতিষ্ঠানিক পত্রিকায় সম্পাদনার পাশাপাশি কিছু লিখতেন ।পেশাগত কারনে আইসিটি সংশ্লিষ্টতায় দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ফেইজবুকে.২০১৭ সাল থেকে শখের বসে মাঝেমধ্যে লেখেন।আগের মত হয়না তাই প্রকাশনারও উদ্যোগ নেয়া হয়না।
পুরস্কারঃপুরস্কার যা পাওয়ার স্কুলজীবনে পাওয়া।ফেইজবুকের বিভিন্ন গ্রুপে মাঝেমধ্যে দৈনিক,সাপ্তাহিক বা মাসিক নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হিসেবে উল্লেখ থাকে।