1. fancy615439@gmail.com : Jannatul Ferdous Abodhi : Jannatul Ferdous Abodhi
  2. ahmedsuman307@gmail.com : Ahmed Suman : Ahmed Suman
  3. rakibowasim@gmail.com : Rakib-Ul Islam : Rakib-Ul Islam
সেলিনা হোসেনের গল্প : সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত। 'কাব্য কথা' - দৈনিক সপ্তস্বরা
সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৮ অপরাহ্ন

সেলিনা হোসেনের গল্প : সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত। ‘কাব্য কথা’

প্রতিবেদকের নাম :
  • প্রকাশের সময় : রবিবার, ২০ জুন, ২০২১

উচ্চবর্গ’ এবং ‘নিম্নবর্গ’ ধারণাটির সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা হয়েছে সামাজিক সম্পর্কের সেই সমতলে যেখানে ক্ষমতাই মূল কথা। যেখানে প্রভুত্ব বা অধীনতার এক বিশিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সামাজিক সম্পর্কটি বাঁধা থাকে। উচ্চবর্গ এবং নিম্নবর্গ বিশ্লেষণের লক্ষ্য হলো সমাজকাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস ও পুনরাবর্তনের প্রক্রিয়াগুলোকে তাদের মৌলিক উপাদানে বিভক্ত করে দেখা।’

তাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতের সঙ্গে আরো কিছু যুক্ত করে বলা যায়- নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক হিসাব-নিকেশ হলো সুদ, খাজনা সবই দেবে কিন্তু পাবে না ফসলের ন্যায্য হিসাব। উচ্চবর্গ কর্তৃক সে হবে প্রতিনিয়ত শোষিত। নিম্নবর্গের অর্থনীতি জড়িত থাকে রাজনীতির সঙ্গে।

 

এদিকে রণজিৎ গুহ মনে করেন, ‘নিম্নবর্গের অর্থনৈতিক ইতিহাসকে তাই ব্যাপক অর্থে যা রাজনৈতিক ইতিহাস নামে পরিচিত তারই শাখা বলে ভাবা যায়, যদিও নিঃসন্দেহেই তা সেই জ্ঞানকান্ডের একটি পৌঢ় ও বহু পল্লবিত শাখা।’ নিম্নবর্গ সমাজের নিম্নস্তরে বাস করার সঙ্গে সঙ্গে এমন এক পেশাকে অবলম্বন করে জীবনধারণ করে যা সমাজে কোনো উচ্চমর্যাদা পায় না। তাদের অর্থনৈতিক হিসাব একেবারে ভিন্ন এবং আলাদা সমাজের ধনাঢ্য উচ্চবর্গীয়দের থেকে। কোনোরকমে জীবনকে বাঁচানোই মূল উপজীব্য হয়ে উঠে। তাদের পেশা ভাবনাও খুবই দুর্বল। গভীর জলে পড়ে গেলে মানুষ যেমন সামনে যা পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে আবার জীবনের স্বাদ পেতে চায়, তেমনি কোনো একটি পেশাকে অবলম্বন করেই তারা জীবনকে অতিবাহিত করার চেষ্টা করে। এককথায় সমাজের নিম্নস্তরে যেমন তাদের বসবাস তেমনি পেশাও হয়ে থাকে একেবারে অমর্যাদাকর- যার উপর ভর করেই তাদের পরিবার-সমাজ চালিত হয়।

সেলিনা হোসেন তাঁর গল্পে এই নিম্নবর্গের মানুষের জীবন পরম মমতায় তুলে এনেছেন। কেননা তিনি সাধারণ মানুষের জীবন দেখেছেন নিবিড়ভাবে এবং জীবন উপলব্ধি করেছেন বলেই তাঁর গল্পে চিত্রিত শ্রমিক, চাষী, কাঠুরে, রিকশাচালক, যৌনকর্মী, পেশাদার খুনীসহ বিচিত্র পেশার মানুষ উঠে এসেছে। তাঁর গল্পে সমাজ-রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিম্নবর্গের দুটি অবস্থার পরিচয় মেলে। যেমন: এক. নিম্নবর্গের ক্ষুধা-দারিদ্র্যের জীবন এবং দুই. নিম্নবর্গ উচ্চবর্গের ক্ষমতাচর্চার শিকার।

‘পৃথিবীর ইতিহাসের মতো দারিদ্র্যের ইতিহাসও প্রাচীন- একথা বলা যায়। সমাজ-অর্থনৈতিক কাঠামোয় উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে প্রভু ও অধীনের সম্পর্কটি যে বিশিষ্টরূপে প্রকট হয় তা শোষক শোষিতের সম্পর্ক। শোষক-শাসিতের সম্পর্ক বজায় থাকে মজুরি, খাজনা, ঋণ ইত্যাদি অনুষঙ্গে; যার অবশ্যম্ভাবী ফল দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ, জমি হারানো, ফসলের ন্যায্য ভাগ থেকে বঞ্চিত হওয়া। আবার শোষকের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে শোষিতের সামান্য একটি অংশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে অধিকাংশকেই দরিদ্রতর করে তোলা।’ জহর সেনমজুমদার সত্যটাই স্পষ্ট করেছেন। আমরা জানি আমাদের চারপাশে ভিড় দরিদ্র মানুষের, তাদের হাহাকারে বাতাস ভারি হয়। সেলিনা হোসেনের গল্পে চরিত্র ক্ষুধা-দারিদ্র্যে জর্জরিত। চরিত্র এ অবস্থা থেকে বের হওয়ার জন্য নানা পথের সন্ধান করে, কিন্তু ফল সুখকর নয়। উচ্চবর্গ, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সরকার কিংবা সরকার প্রেরিত পুলিশ বাহিনী তাদের দারিদ্র্যকে আরো প্রকট করে। ক্ষুধা-দারিদ্র্য, অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পাওয়া লক্ষ্যে তারা কাঠ কাটে, অন্যের ক্ষেতে দিনমজুর হিসেবে কাজ করে, রিকশা চালায়, যৌনতায় আবদ্ধ হয়, টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যা করে। অর্থনৈতিক দুরবস্থা তাদের জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে।

সেলিনা হোসেনের ‘লঙ্গরখানা’ গল্পটির বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- গল্পে নূর আলী মিল শ্রমিক, অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে সংসার চলে। কিন্তু তা আরো দুর্বিষহ হয় মিল বন্ধ হয়ে গেলে। তার সংসারে যে বিপর্যয় আসে তা হলো- ক. ভাতের বদলে কচু শাক খেতে হয়, দোকানে অন্যের ফেলে দেওয়া পঁচা কলার অর্ধেক খায় এবং বিড়ির টুকরো কুড়িয়ে টানে। ভাত খাওয়ার আগে পানি খেতে হয় যাতে অল্প ভাতেই পেট ভরে যায়। খ. নূর আলীর কাশি বাড়ে, হাঁটতে ধরলে পা কাঁপে। গ. নূর আলী এবং তার মেয়ে মিলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে, পরিকল্পনায় থাকে নূর আলীর রিকশা চালানো এবং ছেলে মজনু বাজারে কাজ করবে সেই প্রসঙ্গ। এর মধ্যে মেয়ে এবং স্ত্রী অন্যের বাড়িতে কাজ শুরু করেছে। তারা চেয়েছিল অভাব-অনটনের ভেতরেও একটি সুখী জীবন। কিন্তু সরকার ঘোষণা ছাড়াই মিল বন্ধ করে দিয়ে তাদের জীবন আখ্যান বেদনাকাতর করে তোলে।

তাদের লঙ্গরখানায় খিচুড়ি খেতে যেতে হয়, এখানেও আসে বাঁধা। পুলিশ ঘরে ঘরে ঘোষণা দিয়ে যায়, ‘আবার যদি কেউ রিলিফের জন্য থালা হাতে দাঁড়াবে তো পিটিয়ে পাছার ছাল তুলবো।’ ত্রাণ দিতে যারা আসে পুলিশ তাদেরকে শাসায়, ‘বেশি কথা বলবেন না কিন্তু। কাল থেকে খিচুড়ি রান্না বন্ধ। জোর করে চেষ্টা করলে তার ফলও পেতে হবে।’

পুলিশের জোর জবরদস্তির কারণে ত্রাণকর্তারা না এলে শূন্য মাঠে বসে থাকে নূর আলী। ‘রাজনীতি সুস্থ না হলে জনজীবন পীড়িত হয়। অসুস্থ রাজনীতির কাছে জিম্মি হয় মানুষ। রাজনীতির প্রভাবশালীরা ক্ষুধার্ত রাখে প্রান্তিক জনগোষ্ঠিকে।’ নূর আলীর পেটে ক্ষুধা, সংসারে প্রত্যেকের পেটে ক্ষুধা; তাদের খাবার দরকার। পুলিশ এসে তার চুলের মুঠি ধরে বলে: এখানে বসে আছিস যে? দেশে কি আকাল নেমেছে?
: দ্যাশে নামে নাই, পাট শ্রমিকের কলোনিতে আকাল নামছে। কাজ নাই, ভাত নাই।
: বাড়ি যা শুয়োরের বাচ্চা।
: গালি দ্যান ক্যান ?
: ফের মুখে কথা বলবি তো লাথি মেরে পাছা ফাটিয়ে ফেলবো। ভাগ এখান থেকে।

 

‘পাছা ফাটিয়ে ফেলবো’ পুলিশের এমন কথায় নূর আলী ব্যঙ্গাত্মক উক্তি করে, ‘… লাথি খাইতে খাইতে আমার পাছা শ্যাষ। আমার শরীলে ওই অঙ্গডা নাই। … পুলিশ সাব আপনের সরকারের পাছাডা অনেক বড় আর মোডা। ওইখানে একডা লাথি দিতে পারেন না?’ এমন বাক্য বিনিময় শেষে নূর আলীর পরিণতি কি হয় সে বিষয়ে গল্পে বলা হয়নি, কিন্তু পরিণতি যাই হোক না কেন একজন ক্ষুধার্ত মানুষের ভেতর বাস্তবতা এবং ব্যঙ্গ এ উক্তিতে প্রকাশিত। নূর আলী দুর্বিষহ জীবনের স্তর অতিক্রম করতে করতে সীমা ছাড়িয়ে গেলে এমন কথা বলেছে। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত জীবন তাকে সাহস জুগিয়েছে এমন কথনে। রাষ্ট্র এবং তার সহায়ক অঙ্গগুলো দুর্বলকে রক্ষা করার বদলে হয়ে ওঠেছে নিপীড়ক, যেমন হয়েছে আলোচ্য গল্পে।

নূর আলীর মতো আরো পাওয়া যায় সাবানির বাবা, গনু মিয়া, সীমান, জব্বুইরা, মকবুল পাটোয়ারি, দাদআলী, ছফদর, আয়াত আলী, মেহের আলী, সাইবা, আক্কাস, আবদুল মান্নান, চান গাজি, শাজাহান, মনতাজ, টাপারা, লীলা, গোপাল, খলিল, নূরুদ্দিন, শফিউল্লাহ, আলিম, আছিয়া, তৈয়ব আলী, মেরাজ, মেঘনাদ, ফুলজানদের। যারা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় যুক্ত থেকে ক্ষুধা-দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য অর্থ উপার্জন করে, কিন্তু এ অবস্থা থেকে মুক্তি আসে না। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে তারা কঠোর পরিশ্রম করে, মুনাফা খুব বেশি আসে না। তারা দারিদ্র্যজর্জরিত জীবনে বঞ্চনা, অবহেলার শিকার হতেই থাকে।

নিম্নবর্গ উচ্চবর্গের ক্ষমতাচর্চার শিকারের ক্ষেত্রে বলা যায়- ‘ক্ষমতা’ একটি বিশেষ শক্তি, যার দ্বারা একজন তার চেয়ে স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্নের উপর বলপ্রয়োগ করতে পারে। এই ক্ষমতা হতে পারে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা অন্য যে কোনো জায়গা থেকে। পার্থ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ‘উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের সম্পর্ক নির্ণয়েও ক্ষমতা মুখ্য। ক্ষমতার মুখেই উচ্চবর্গ সবসময়ই নিজেকে ভাবে প্রভু ও তার নিচে অবস্থান করা মানুষদের করে রাখে অধীনস্ত।’ ফুকো মনে করেন ক্ষমতার খেলা সর্বত্র বিদ্যমান। ক্ষমতার খেলার দুটি পক্ষ থাকে। একটি প্রভু পক্ষ, অন্যটি অধস্তন পক্ষ।

 

সেলিনা হোসেনের গল্পে আমরা এই দুটি পক্ষের সন্ধান পাই। প্রভু পক্ষের মধ্যে রয়েছে সরকার, পাকসেনা, রাজাকার, মালিক, পুলিশ বাহিনী, বিহারী, এন.এস.এফ, চেয়ারম্যান। আর অধস্তন শ্রেণির মধ্যে রয়েছে বস্তিবাসী, সাধারণ মানুষ, মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবার, চাষি, ছাত্র-শিক্ষক, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রভুপক্ষ ক্ষমতাবান বলে অধস্তনরা নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হয়; চর্চিত হয় ক্ষমতা। এমন গল্পগুলো হলো, ‘ক্রোধ’, ‘থাবা’, ‘পাখি ধরা’, ‘খোয়াই নদীর বাঁকবদল’, ‘ভিটেমাটি’, ‘রহমত আলীর শকুন দেখা’, ‘পলাতক রঙ’, ‘দুঃখ’, ‘পরজন্ম’, ‘অনুভবে আলোয়’, ‘বাঁচা’, ‘পুড়ছে’, ‘ঊনসত্তর’, ‘বসন্ত বাউরি’, ‘উৎস থেকে নিরন্তর’, ‘একালের পান্তাবুড়ি’, ‘অরণ্য কুসুম’, ‘স্রোত’ প্রভৃতি।

এখানে ‘ক্রোধ’ শিরোনামের গল্পটি বিশ্লেষণ করছি। ‘ক্রোধ’ গল্পে টিপুর উপলব্ধি এবং প্রত্যক্ষ করা ঘটনায় ক্ষমতাচর্চার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এখানে ক্ষমতাচর্চা করে নেতা নাসির, পুলিশ এবং টিপুর মামা। ক্ষমতাচর্চার শিকার হয় বস্তিবাসী, ছাত্ররা এবং টিপু ও তার মা।

টিপু মা সহ থাকে নীলক্ষেতের বস্তিতে। সেখানে টিপু বস্তির অন্য ছেলেদের জড়ো করে নিজে একটি দল বানিয়েছে। তাদের ভেতর কথোপকথন হয় এবং সেখানে থেকে জানা যায় নাসিরের ক্ষমতাচর্চার বিষয়। নাসির বস্তির সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে ভাড়া নেয়। ভাড়া না দিতে পারলে ঘাড় ধরে বের করে দেয়। জিনিসপত্র তছনছ করে। প্রতিবাদ করলে গুন্ডার সাহায্যে রাতের অন্ধকারে ছুরি বসিয়ে তাকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করলেও পুলিশ তাকে ধরে না, তার বিচার হয় না। কারণ সে আইন, থানা, পুলিশ টাকা দিয়ে নিজের করে নিয়েছে। নির্বিবাদে সে ক্ষমতার চর্চা করে নিরীহ বস্তিবাসীর উপর।

১৯৭৫ সালের পর দেশে সামরিক শাসন শুরু হয় এবং জেনারেল এরশাদের আমলে বিদঘুটে অবস্থা তৈরি হলে ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ করে ভিন্ন পেশার মানুষ। গল্পে ছাত্র ও বস্তির ছেলেদের কথা বলা হয়েছে। বেসামরিক শাসক-শোষকদের নেতৃত্বাধীন শোষণ-শাসন যখন চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে পতিত হয়, যখন তাদের নেতৃত্বে দমনপীড়নও এ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হয় না, তখনই সামরিকবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। বুর্জোয়া শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা ও তা অব্যাহত রাখার জন্যই তারা ক্ষমতায় আসে। ক্ষমতায় আসার পর শাসক নিজের মতো করে দেশ শাসন করতে গিয়ে দমন-নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। জেনারেল এরশাদও এ পদ্ধতি অবলম্বন করেন, সামরিক শাসনব্যবস্থা আরো দীর্ঘ করার জন্য পুলিশ বাহিনীকে পথে-ঘাটে সক্রিয় রাখেন, যাতে কোনো প্রকার হরতাল-অবরোধ না করতে পারে জনতা; কিন্তু অধিকার আদায়ের পথে জনতা তো ভীত হতে শেখেনি। গল্পে ছাত্ররা জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করে, রাস্তায় নামে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় টিপু; সে আসে বস্তি থেকে তার দল নিয়ে। সে সামরিক শাসন প্রসঙ্গে খুব বেশি না জানলেও স্থবির পরিবেশ তার ভালো লাগে না। এমন অবস্থার বিরুদ্ধে মিছিল বের হলে সেও স্লোগান দেয় অন্যদের সঙ্গে।

মিছিলে গুলি চালানোর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচর্চা করে পুলিশ, তারা জেনারেল এরশাদের প্রেরিত বাহিনী। টিয়ার গ্যাস ছোড়ে মিছিল এলোমেলো করে দেয়, লাঠিচার্জ করে, পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে গুলি করে ছাত্রদের উপর, ছাত্ররা নিরস্ত্র। গুলিতে সেলিম এবং দেলোয়ারের মৃত্যু হয়। পুলিশের ক্ষমতাচর্চার শিকার হয় টিপু নিজেও। ‘হাঁ করে স্লোগান দেওয়ার সময়ে পুলিশের গুলি বুক ছুঁড়ে চলে যায় টিপুর। রাস্তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে ও।’ স্বাধীন দেশে পুনরায় সামরিক শাসন চালু হলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সরকার সেনা মোতায়েন করে এবং এই পুলিশ সেনারা এমনই করে চর্চা করে ক্ষমতা অস্ত্রহীন নিরীহ মানুষের উপর।

তৃতীয় ধাপে ক্ষমতাচর্চা করে টিপুর মামা। মামা জোর করে টিপু ও তার মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বাড়ি থেকে তাড়ানোর আগে কৌশলে টিপুর মায়ের ভাগের জমি নিজের নামে লিখে নেয়। বলেছিল টিপুর মাকে :
নিজের পথ নিজে দেখো। আমি আর কতোকাল তোমাগোর মা-পোলারে টানমু। ওর মা বলেছিল, টানন লাগবো ক্যান? আমার জমি? তার ধান?
: তোমার আবার জমি কোনহানে? দলিল তো বেবাক আমার নামে।
: আপনের নামে? কন কি?
: দেখো। এই দেখো।
টিপুর মা চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলেছিল, বলেছিল শয়তান।
মামি চুলের মুঠি চেপে ধরে বলেছিল, আমাগো ভাত খাইয়া আমাগো উপর খবরদারি? নিমকহারাম।
: নিমকহারাম আমি না আপনেরা? সেই দিন আমার টিপসই লইয়া এতোবড়ো শয়তানিডা করতে পারলো ভাইজান?
: বাইর হ, আমার বাড়ি থাইকা বাইর হ ।

তারপর টিপু এবং তার মা নীলক্ষেত বস্তিতে আশ্রয় নেয়। রক্তের সম্পর্কও বেইমানি করলে অসহায় বোধ করে টিপুর মা। পারিবারিকভাবে ক্ষমতাচর্চার শিকার হয় টিপুরা। ক্ষমতাচর্চার শিকার হয়ে টিপুর হাজার মানুষ নিয়ে সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন জায়গায় বসতি স্থাপনের স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যায়, হাজার মানুষের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়।

এ গল্প ছাড়াও উল্লিখিত গল্পগুলোয় নিম্নবর্গ যে উচ্চবর্গ কর্তৃক ক্ষমতাচর্চার শিকার তা যোক্তিক এবং গল্পকারের বর্ণনার কৌশলে তা আরো বাস্তব ও বস্তুনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। গল্পে মুক্তিযোদ্ধা, সনাতন ধর্মাবলম্বী, বর্গাচাষি, আদিবাসী, বস্তিবাসী, ছাত্র, গড়িগাঁ, রমিজদের মতো দরিদ্র মানুষ পাওয়া যায়, যারা ক্ষমতাচর্চার শিকার। ক্ষমতাচর্চা করেছে পাকসেনা, মালিকগোষ্ঠী, সরকার, বিহারী, পুলিশ বাহিনী, রাজাকার; কেননা তাদের রয়েছে বিত্ত, অস্ত্র এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতা।

সেলিনা হোসেনের ছোটগল্পে নিম্নবর্গের পাওয়া, না-পাওয়া, দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা বেশ জোরালো। গল্পে নিম্নবর্গের সমাজ হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে কৃষি সমাজ, রিকশাচালক, যৌনকর্মী, শ্রমিক, কাঠুরে, পেশাদার খুনী, আদিবাসী প্রভৃতি সমাজ। কেননা এ সমাজের মানুষদের তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন খুব কাছ থেকে। শৈশব-কৈশোরেই তাদের সম্পর্কে তিনি জেনেছেন, দেখেছেন নিম্নবর্গের জীবন। তিনি সাধারণ মানুষদের পক্ষে নিজের কলম সব সময় সোচ্চার রেখেছেন বলেই গল্পে নিম্নবর্গের দারিদ্র্য, মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধপরবর্তীকালের যন্ত্রণাময় অবস্থার বিবরণ, ধনীদরিদ্রের স্থায়ী প্রভেদ কাঠামোয় গড়ে ওঠা জীবনব্যবস্থা, ক্ষমতার জোরে উচ্চবর্গের সন্ত্রাস কায়েম রাখার সামাজিক বাস্তবতার অনুপুঙ্খ বর্ণনা এসেছে।

ফেইসবুক আইডি থেকে মন্তব্য করুন :

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সমজাতীয়
© All rights reserved © 2022 swaptasora
কারিগরি সহযোগিতায় : মোস্তাকিম জনি